মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৭ অপরাহ্ন

পীর হাবিবুর রহমান ছিলেন নতুন প্রজন্মের পথিকৃৎ

Reporter Name / ৭০ Time View
Update : মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৭ অপরাহ্ন

সাঈদ চৌধুরী: সাহসী সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক পীর হাবিবুর রহমান (১২ নভেম্বর ১৯৬৩-৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২) ছিলেন আমাদের নতুন প্রজন্মের পথিকৃৎ। বাংলাদেশে অধিক সংখ্যক সাংবাদিক যখন সরকার দলীয় রাজনীতিকদের প্রশ্ন করতে ভুলে গেছেন, তখন পীর হাবিবুর রহমান দেখিয়ে দেন কিভাবে টেনে আনতে হয় আসল তথ্য।

দলীয় সেবাদাস হিসেবে কালোকে সাদা আর সাদাকে কালো বলছেন যারা, তাদের জন্য তিনি ছিলেন আতঙ্ক। তিনি প্রমাণ করেছেন সাংবাদিকতা শুধু রুটি রুজি নয়, সমাজ বদলের হাতিয়ার। মিডিয়ার কাজ নিছক তথ্য প্রকাশ নয়, নান্দনিকতার সাথে সত্যকে তুলে ধরাও বিশাল একটি বিষয়। মহৎ ও মানবিক সাংবাদিকতায় পীর হাবিবুর রহমান একজন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। জীবনের শেষ লগ্নেও সাহসের সাথে উচ্চারণ করেছেন, “জীবনটাকে সহজ সরল রেখায় দেখি। মান মর্যাদার সাথে জীবন কাটিয়ে দিতে পারলেই হয়। আনন্দটাই বড়। মায়া মমতা আবেগ বিশ্বাস সারল্য ও নূন্যতম নীতিবোধ নিয়ে হেসে খেলে গেলেই হয়। জীবনে ঠকেছি অনেক, যারা ঠকিয়েছে তারা লাভবান কতটা হয়েছে জানিনা। তবে আমার জীবনের খুব বড় লোকসান যে হয়েছে তা নয়। আত্নমর্যাদা নিয়ে সততার জীবন কত কষ্টের, জীবনের পরতে পরতে জেনেছি, তবু হাল ছাড়িনি। লাভ লোকসানের হিসেবে যারতার কাছে নত হতেও পারিনি! যারতার সাথে চলিওনি। আত্নমর্যাদার অহংকার অহম থাকলেও কাউকে ছোট করে দেখিনি। তবে সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে যেমন শিখেছি, তেমনি অসৎকে অপদার্থকে মুখের উপর বলেছি, সৎ যোগ্যকে মর্যাদা দিতে কার্পন্য করিনি। কোন শাসকের কাছ থেকে আমি কোন সুবিধা নেইনি। সরকারি প্লটও নয়।”

একজন সিনিয়র সম্পাদক উত্তর ইংল্যান্ডের এক স্থানীয় রেডিও স্টেশনে তার প্রথম এ্যাসাইনমেন্ট-এর কথা মনে করে বলছেন ‘তখন ক্ষমতায় ছিলেন মারগারেট থ্যাচার। আফগানিস্তানে আক্রমণ চালানোর জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেন। আমি তখন নিজেকে স্থানীয় একজন ব্যবসায়ীর জায়গায় কল্পনা করলাম। তারপর স্থানীয় এক রপ্তানিকারক কোম্পানির প্রধান নির্বাহীকে আগাম যোগাযোগ ছাড়াই টেলিফোন করলাম। তিনি ক্ষমতাসীন টোরি দলের স্থানীয় একজন নেতা ছিলেন এবং সরকারের বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত ছিলেন। তার সাথে সাক্ষাৎকার আমাদের নিউজ বুলেটিনের লিড স্টোরি হয়ে যায়। সাক্ষাৎকারের ফলো-আপ দিয়ে স্থানীয় পত্রিকা এবং আঞ্চলিক টেলিভিশনের প্রধান খবর হয়ে যায়।’

পীর হাবিবুর রহমান এভাবেই রাজনীতির ভেতর থেকে অর্থনীতির খবর বের করতেন। এমন ঘটনা তার জীবনে অনেক আছে। যে কোন বিষয়ে গভীর ভাবে জানার কৌতূহল এবং জানার আগ্রহ তার লেখায় নতুন মাত্রা দিয়েছে। ক্ষুরধার লেখনী এবং সাহসী সাংবাদিকতার কারণে শাসকের রোষানলে পড়েছেন বার বার। ভাল কাজের প্রাণখোলা প্রশংসা এবং খারাপের নিমোর্হ সমালোচনায় তিনি ছিলেন নির্ভীক ও সোচ্চার। ঝুঁকিপূর্ণ অনুসন্ধানি প্রতিবেদন তাকে নিয়ে এসেছে অনন্য উচ্চতায়। সাংবাদিকতা জীবনে কখনোত তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। স্বার্থ ও প্রলোভন তাকে গ্রাস করেনি। বর্তমান প্রজন্মের সাংবাদিকরা তাকে অনুসরণ করলে হয়ত ধুঁকতে থাকা গণমাধ্যমের সুদিন ফিরবে।

মৌলিক সাংবাদিকতার জন্য প্রয়োজন সময়, মনোযোগ এবং পরিশ্রম। পীর হাবিবুর রহমানের মতো বলিষ্ঠ ও পরিশ্রমী সাংবাদিক খুব কমই দেখা যায়। সাহসিকতার পাশাপাশি সাংবাদিকতায় তার মানবিক মূল্যবোধও ফুটে উঠে। মৌলিক সাংবাদিকতার জন্য যে নৈপুণ্য দরকার, যে ধরণের মানবিক গুণ আবশ্যক তা তিনি সঠিক ভাবে রপ্ত করেছেন। তিনি টেলিভিশন টক-শোতে সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কথা বলে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।

নিজের জন্ম ও বেড়ে ওঠা নিয়ে পীর হাবিবুর রহমানের স্মৃতি যে কোন সংস্কৃতিবান মানুষকে আপ্লুত করে। ইন্তেকালের কিছু দিন আগে তিনি লিখেছেন “সেই ১৯৬৩ সালের ১২ নভেম্বর বেলা ১২টায় জলজোছনার শহর সুনামগন্জের বাড়িতে জন্মেছিলাম! কত বছর! কত দ্রুত গড়িয়ে গেলো! হৃদয়ে তিনটি রিং শোভা পাচ্ছে। এতো নিয়ম না মানা জীবন আমার শৈশব থেকে দূড়ন্ত কৈশোর হয়ে উচ্ছল তারুন্যের পথ পেরিয়ে এখন দেখি হঠাৎ মধ্যগগনের সূর্য পশ্চিমে ক্রমশ হেলে পড়ছে! মৃত্যুর পথে হাটছি। তবু ছোট্ট এই জীবনের বড় সময় লেখাপড়া, ছাত্ররাজনীতি, পেশাগত জীবন, ঘরসংসার, টানাপোড়েন, উত্থান পতন, সাফল্য ব্যর্থতা, আনন্দ বেদনা মিলে কালের আয়নায় মহাকাব্যের চেয়ে কম কই? আপন মনে ভেবেছি, জেনেছি এক মুহুর্তের নাই ভরসা। এ জীবনে এক মুহুর্তের আনন্দই অমূল্য সম্পদ! জীবন তাই রহস্যময় হলেও সততই মহা আনন্দের। মৃত্যু মানেই সব শেষ, আর বেচে থাকার আনন্দই নিয়ত উপভোগ আর অভিজ্ঞতা!”

“আমার বাবা মা ভীষন সহজ সরল আর খোদাভীরু পরহেজগার ছিলেন। আল্লাহর উপর ছিলো অগাধ বিশ্বাস। তাই মহান দয়াময়ের কাছেই সপে দিয়েছিলেন নিজেদের। মানুষের উপকার ছাড়া অপকার করেননি। পরিবার থেকেই এই শিক্ষা পেয়েছিলাম আমরা। পাইনি তাদের পবিত্র জীবন। তবে ঠকলেও জীবনের পরতে পরতে কাউকেই ঠকাইনি, চেষ্টা করেছি মানুষের বিপদে ঝাপ দিতে, সাহায্যের হাত বাড়াতে! উপকার করলেও ক্ষতি করিনি তাই কাউকে ঠকাইনি। আমার সন্তান তার দাদার মতোন সেই মানবিক গুনগুলি পাক, যেমন সততা ও কারো কিছুতে নাক না গলানো ও কারো অপকার না করার। যে কোন খারাপ সময়ে আমি বাবার দোয়াই চেয়েছি। তিনি জীবিতকালে ও মৃত্যুর পর এখনো। আল্লাহ আমার বাবা মাকে বেহেস্ত দিবেন, এ আমার বিশ্বাস।”

নিজের পারিবারিক শিক্ষা সম্পর্কে পীর হাবিবুর রহমানের মূল্যায়ন খুবই শিক্ষণীয়। “পরিবার আমাকে দিয়েছে মানবিক মূল্যবোধ। পরিবার সমাজ দিয়েছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। পরিবার থেকেই পাঠ নিয়েছি গনতান্ত্রীক চেতনার, জেনেছি শৃঙ্খল ভেঙ্গেই স্বাধীনতাভোগ করতে! মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে গৌরবের কিছু নেই, মানুষকে ভালোবাসার চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু নেই তাও পরিবার থেকেই নেয়া পাঠ। শহরের বুকচিরে বহমান সুরমা, মেঘালয়ের কোলে শুয়ে থাকা শহরের চারদিকে অথৈ জলরাশির হাওর, আসমান ভেঙ্গে নেমে আসা জোছনা, চন্দনি রাত, তারাভরা আকাশ, আমার শুকতারা, ধ্রুবতারা প্রেমিক হৃদয়ে আবেগ নির্ভর এক রোমান্টিক মানুষ হিসেবে নির্মান করেছে! প্রকৃতির কাছে কি যে জন্মের ঋন আমার! ছেলেবেলায় কত বাছুর নিয়ে, ঘুড়ি নিয়ে, গুলতি নিয়ে বনে বাদারে ঘুরেছি, খেলেছি কত মাঠে মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট, টেবিল টেনিস, আহা তারও আগে সে কি লুকোচুরি! অবাধ্য দুপুরে পুকুরে সাতার। কত শাসন, অনুশাসন! দমিয়ে রাখতে পারলো কই? বেহিসেবি জীবনে মাথা নির্ভর চলিনি, হিসেব বুঝিনি! হৃদয় বুঝেছি, হৃদয় নির্ভর জীবনে ভালোবাসাই বুঝেছি! যাকে বুক তাকে নয় পিঠ। যাকে ভালোবাসিনি বিরক্ত দূরে থাক ত্রিসীমানায় যাইনি! যাকে ভালোবেসেছি, আশ্রয় পেয়েছি তার কাছেই বারেবারে গেছি। কাউকে ঠকাইনি, কারো উপকার করতে না পারি ক্ষতি করতে শিখিনি! ক্ষতির পাল্লা নিজেরটাই ভারি করেছি।”

“জন্মেছিলাম সে এক উত্তাল সময়ে! উজানে সাতার কেটেই কেটেছে জীবন, জানি উজানেই তার ইতি হবে। একজীবনে কি করেছি জানিনা, তবে এটা নিশ্চিত মানুষের পাশে হৃদয় দিয়ে ছিলাম বলে মরনে অন্তত মানুষ শেষ দেখা দেখতে আসবে। স্বাধীনচেতা দৃঢ় মনোবল নিয়ে যতোটা লিখতে চেয়েছি ততোটা পারিনি। যতোটা বলতে ততোটাও নয়! তবে দেশ ও মানুষকে ভালোবেসেছিলাম। যেমন করে ভালোবেসেছিলাম, ফুল পাখি নদী হাওর বৃক্ষ, জোছনারাত, ও বর্ষনমুখর বৃষ্টির সন্ধা তেমন করেই। আমারও অনেক বাস্তব স্বপ্নের মৃত্যু ঘটেছে চারিত্রিক কারনে। আমি অনেক কিছু বদলাতে না পারি, নিজেকে খুব বদলাইনি। বন্ধু ভাগ্য এতো ভালো যাকে তাকে বন্ধু বলতে পারিনি। সস্তা মানুষের জন্য আমার করুনা যেমন চীরকালের, তেমনি মর্যাদাবান মানুষের প্রতি অবিরাম শ্রদ্ধা। ভালোবাসার চেয়ে বড় কোন শক্তি মানুষের আছে বলে মনে হয়না আমার। আমি ভালোবাসা যেমন দিয়েছি, তেমন পেয়েছি! এটাই আমার অহংকার। ভালোবাসার পথ ধরেই একদিন জীবনের ইতি ঘটুক। আড্ডার চেয়ে প্রিয় কোন আকর্ষন আমার নেই। আর স্বাধীনভাবে লেখার চেয়ে তৃপ্তি। জন্মদিন এলে মনে হয় বাবা, মা আট ভাইবোনের সেই আনন্দমাখা বাড়ির কথা। গাছগাছালির বাড়িতে কত ফলজবৃক্ষ মায়ের হাতের! পেশাগত জীবন আমার কাছে যদিও ইবাদত তবু মাঝে মাঝে খুব আফসোস হয়, যদি ভুল করে জীবনে কুড়ি বছর হলেও পিছিনে যেতে পারতাম! আহারে, আমার ফেলে আসা মধুময় সোনালী জীবন!”

পীর হাবিবুর রহমানের জন্ম ১২ নভেম্বর, ১৯৬৩, সুনামগঞ্জ শহরে। বাবা মরহুম রইস আলী পীর ও মা মরহুমা সৈয়দা রহিমা খানম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পীর হাবিবুর রহমান ১৯৮৪ সালে মতিহার ক্যাম্পাসে সাংবাদিকতার হাতেখড়ি নেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পীর হাবিবুর রহমান ১৯৮৫ সালে সেনাশাসন আমলে কারাবরণ করেন। ‘৯২ সাল থেকে বাংলাবাজার পত্রিকা ও ‘৯৯ সালে যুগান্তরের নির্মাণ বিনির্মাণ পর্বে রাজনৈতিক রিপোর্টার হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। অনুসন্ধিৎসু পাঠকের তৃষ্ণা নিবারণ করেছেন আলোচিত সব খবর দিয়ে। ১/১১-এ আমাদের সময়ে আলোচিত কলামিস্ট হিসেবে পাঠক মহলে নিজেকে উন্মোচিত করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে সাহিত্যের রসবোধতার এক-একটি কলাম ভাষাশৈলীতে পাঠককে টেনে নিয়ে যায় চিন্তার জগতে। আমাদের সময়-এ কিছু দিন উপ-সম্পাদক পদে কাজ করেছেন। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তরুণ প্রজন্মের অনলাইন পূর্বপশ্চিম বিডি. নিউজের প্রধান সম্পাদকছিলেন। ২০২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন। আমীন।

লেখক
সাঈদ চৌধুরী
সময় সম্পাদক, কবি ও কথা সাহিত্যিক।


এই ক্যাটাগরি আরও পড়ুন

তারিখ অনুসারে পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০৩১  
এক ক্লিকে বিভাগের খবর